অচেনা স্বাধীনতা - পর্ব ২
Updated: Aug 1, 2020
ইতিহাসের অচেনা ডায়রি ঘটতে বসলে কত যে অজানা নাম উঠে আসে সে পাতায়, তার খোঁজেই অচেনা স্বাধীনতার পথ চলা। চাইলে তাদের অনেকেই ভালো চাকরি খুঁজে সুখে থাকতে পারতেন সারা জীবন। কিন্তু তা না করে অর্থ যশ এসব উপেক্ষা করে্, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলিদানের পথে। তাদের কাছে সবই ছিল এক লক্ষ্যে স্থির বিশ্বাস। সবই ছিল সেই নিজ মাটিকে ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই, যেখানে বারে বারে হানা দিয়েছে দুর্বৃত্ত বহিরাগত। শুধু লড়াই করে যাওয়া রক্ত ঝড়েছিল ইতিহাসের পাতায় পাতায়। শুরুতেই কুর্নিশ ও প্রণাম জানাই সেই সব নির্ভয় হৃদয়কে, যারা আজকের আমাদেরকে নিঃস্বাস নিতে শিখিয়ে গিয়েছিলেন।
আজকের পর্বে আমরা চিনবো আরেক অচেনা সংগ্রামীকে। পাণ্ডুরাং মহাদেব বপট। সবাই যাকে চিনতো সেনাপতি বপট হিসাবে। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক অন্যতম পথিকৃৎ সেনাপাতি বপট হিন্দুত্ব আর গান্ধী মতাদর্শে দীক্ষিত ছিলেন। বপট সেনাপাতি হিসাবে পরিচিতি পান যখন তিনি ১৯২১ সালে মুলশি সত্যাগ্রহতে নেতৃত্ব দেন। এই মুলশি সত্যাগ্রহ পৃথিবীর প্রথম কৃষকদের সংগঠিত সংগ্রাম, যা তাদের কৃষিজমি অন্যায় ভাবে ইংরেজদের বেদখলের বিরুদ্ধে করা হয়েছিল।
১২ই নভেম্বর, ১৮৮০, মহারাষ্ট্রের আহমেদনগরের এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে পাণ্ডুরাং মহাদেব বপটের জন্ম হয়েছিল। পুনের ডেকান কলেজে ভর্তি থেকে তার জীবনে পরিবর্তনের সূচনা। বিপ্লবী চপেকার ক্লাবে যোগদান দেওয়া থেকে শুরু। তারপর তিনি দামোদর বলবন্তু ভিদে ও প্রফেসর ফ্রান্সিস উইলিয়াম বেইনের সংস্পর্শে আসেন। তাদের ভারতীয় ছাত্রদের জাতীয়তাবাদ নিয়ে চর্চা ধীরে ধীরে বপটকে দেশের স্বাধীনতার সংস্পর্শে আনতে শুরু করে।
সাল ১৯০৪, বরাবরের উচ্চমানের ছাত্র বপট ইংল্যান্ডের এডিনবার্গে হেরিওট ওয়াট কলেজে পড়ার সুযোগ পান। স্কলারশিপ নিয়ে তিনি বিদেশে যাত্রা করলেন। সেইসময় দাদাভাই নৌরোজির লেখা "দারিদ্র ভারত" বইটি তাকে মানসিকভাবে ইংরেজ বিরোধী করে তোলে। ইংল্যান্ডে থাকাকালীন, ইংরেজ সমাজবাদে আগ্রহী হয়ে পড়েন ও রাশিয়ান বিপ্লবীদের সাহচর্যে আসেন। সেই সময় তার ইংরেজ বিরোধী বক্তৃতা তাকে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ বলে স্বীকৃতি দেয়। ফলস্বরূপ, ১৯০৭ সালে তিনি স্কলারশিপ হারান।
এই সময়, রাশিয়ান বিপ্লবীদের সহায়তায় পরিচয় হয় ভি ডি সভরকরের সাথে। সেখানেই তার বোম্ব বানানোর হাতেখড়ি। সেই শিক্ষা পরবর্তীকালে প্রতিফলিত হয় বিখ্যাত আলিপুর বোম্ব ট্রায়ালে। তিনি এরপর আরো কিছু সক্রিয় বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯১২ সালে চন্দননগরের মেয়রকে মারার ষড়যন্ত্রে তাকে বন্দি বানানো হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাবে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় ইংরেজ সরকার।

এরপর তিনি মহারাষ্ট্রে ফিরে আসেন ও হিন্দুত্ব আর গান্ধী মতে আসক্ত হন। অহিংস মতে বিশ্বাসী হয়ে তিনি যোগ দেন বাল গঙ্গাধর তিলকের সাথে পুনেতে অহিংস সংগ্রাম শুরু করেন। ১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর স্বরাজ আদর্শে দীক্ষা নেন। এইসময় তার শুরু হয় মূলশি সত্যাগ্রহ। ৩ বছর ধরে চলা এই অহিংস লড়াইয়ে উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলস্বরূপ তাকে বন্দি করে ইংরেজ। সেইসময় তিনি একটি নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন, "শুদ্ধ সত্যাগ্রহ"। অহিংস ও সহিংসতা মিশ্রিত এই বিরোধ অনেকাংশে ছিল আত্ম বলিদানের এক রূপ। ৭ বছরের বন্দি থেকে ১৯৩১ সালে তিনি মুক্তি পান। এরপর অনেক আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত হন। হায়দ্রাবাদ সত্যাগ্রহ, সাম্যুক্ত আন্দোলন, গোয়ার মুক্তি আন্দোলন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
সাল ১৯৪৭। ১৫ আগস্টে পুনেতে প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তলন হয় তার হাতেই। ২৮শে নভেম্বর, ১৯৬৭। ৮৭ বছর বয়সে তার প্রয়াণ হয়।
মহারাষ্ট্রের একটি রাস্তা, ভারতের একটি পোস্টাল স্ট্যাম্প, অমর চিত্র কথা ১৯৬৪, এর বাইরে গোপনে থেকে গেছে তার সারাজীবনের কীর্তি। কিছু ইতিহাসবিদের নোটস এর হিসাবে থেকে গেছে বাকিটা। অনেকেই জানে না, অনেকেই ভুলে গেছে তার বলিদান। আজ একবার স্মরণে হাতেখড়ির অজস্র প্রণাম আপনার চরণে।
কেমন লাগলো জানাবেন। পরবর্তী পর্বে আবার আসবো অচেনা সত্য নিয়ে। সেই সত্য, যা আমাদের বর্তমান স্তম্ভ।
Ref:
1) The myth of the Lokamanya : Tilak and mass politics in Maharashtra by Cashman Richard.
2) Shodhganga - Chapter 6.
3) A history of terrorism by Laqueur Walter.
4) Indian Post website.
5) Social Movement In India by Ghanshyam Shah.