top of page

Onomatopoeia -নিশাচর

তখন আমরা ক্লাস ইলেভেনে পড়ি ।

ভয়ডর বলতে কিছু নেই -শুধু পরীক্ষায় পাস ফেল ছাড়া ।

আমরা তখন আড্ডা দিতাম চন্দননগর স্ট্যান্ডে । নতুন টানতে শেখা তামাকের গন্ধ মন্দ লাগতো না।ফেলুদাকে অনুকরণ করে চারমিনারে দিতাম সুখটান । গঙ্গার হাওয়া আর চারমিনারের তখন জুড়ি মেলা ভার ।


চন্দননগর স্ট্যান্ড তখনও এতো সেজে ওঠেনি । এতো রোশনাই ,এতো খাবারের দোকান,এতো মানুষের ভিড় তখন ছিল না । সূর্য ডোবার সাথে সাথেই অন্ধকার নেমে আসতো।


বরোদাকে তখন আমরা চিনতাম না । ও ছাড়া বাকি আমরা সবাই থাকতাম সেই আড্ডার আসরে ।

প্রাইভেট টিউশনের পর, ওখানে সবার দেখা হতো , কথা হতো , উঠতো ধোঁয়া - শেষে পরে থাকতো ফাঁকা বেঞ্চ আর কিছু নিভে যাওয়া সিগারেটের অবশেষ।


নীলাদ্রি ওরফে নীলু বরাবরই বাংলায় বেশ ভালো ছিল । আমরা তখন প্রাইভেট টিউশন পড়ি সুনীল বাবুর বাড়িতে । সুনীল বাবুর মতন বাংলার টিচার এ তল্লাটে পাওয়া মুশকিল ছিল সেই সময়ে । নীলাদ্রি আর ভ্যামো দুজনে পড়তে যেত একসাথে , একসময়ে । আমাদের ব্যাচ আর সময় ছিল আলাদা ।

সুনীলবাবুর নাম স্বয়ং রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।ওনার বাবা রবীন্দ্রনাথের এস্টেট এ খাতা দেখার কাজ করতেন।ওনার নামকরণের ঘটনাটা জানার পর থেকে ওনাকে আমরা বেশ সমীহ করতাম -আর তাছাড়া ওনার পড়ানোর কায়দা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন । উনি নিজে নোটস দিতেন না , আমাদের নিজেদের লিখতে বলে কল্পনা শক্তিকে বাড়াতে সাহায্য করতেন- আমাদের লেখার রাস্তাটা ধরিয়ে দিতেন ।

এবার আসা যাক মূল গল্পে -


সেদিন স্ট্যান্ড এর ধারের আড্ডাটা বেশ জমেছে । যদিও আবহাওয়া বেশ গুমোট তখন। নিশীদার লেবু চায়ের স্বাদে আলোচনার ঝড় উঠেছে -বিষয় - আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল ।


দত্ত বললো - " ধুর- ধুর - রোনাল্ডিনহোর ধরে কাছে কেউ আসে না -তোদের রিকুল্মে ক্রেসপো সব বাচ্চা।"

সিধু প্রতিবাদ জানালো -" আরে রাখ - এবার ওয়ার্ল্ড কাপ আমাদের । এবার আমাদের কোচ বিয়েলসা।"

সায়ন হাসলো -" কেন জিদান কি দোষ করলো !"

আলোচনার পারদ যখন বেশ চড়ছে ,তখন দেখি নীলু আর ভ্যামো এসে হাজির । সাইকেল স্ট্যান্ড করে আমাদের কাছে এগিয়ে এলো।

দত্ত বললো -" নাও আরেক আর্জেন্টাইন ফ্যান এলেন ।"

বলার উদ্দেশ্য ভ্যামো । ও আবার আর্জেন্টিনা বলতে পাগল । কিন্তু সবাইকে অবাক করে সে বললো -

" ও সব কথা পরে হবে। আজ যা ডুয়েল দেখলাম সে গল্প আগে শোন্ ।"

দত্ত বললো - "মারপিট ?"

ভ্যামো মাথা নাড়লো - " নাহে- এ রোমের সেনেটের মতন লড়াই -বাক্যে আর বক্তব্যে ..."

নীলুর মুখটা শুকনো । অন্যদিকে তাকিয়ে আছে ।

ভ্যামো বললো - " শ্রেয়া তো আমাদের ব্যাচেই- তার সাথে এসে জুটেছে ওই পিসটা .."

বোঝা গেলো ও কার কথা বলছে । শ্রেয়াকে নীলু বেশ পছন্দ করে অনেকদিন ধরেই , কিন্তু না ওর মন বুঝে উঠতে পারছে , না পারছে ওকে বলতে । ওই ব্যাচের ই আরেকজন -নাম আদক-তার ও আবার পছন্দ শ্রেয়াকে । এই নিয়ে নীলু আর আদকের মধ্যে বেশ একটা কোল্ড ওয়ার -কোল্ড ওয়ার জাতীয় ব্যাপার শুরু হয়েছে । কার যে চিড়ে ভিজবে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ।


ভ্যামো বললো -" শ্রেয়া স্যার কে জিজ্ঞেস করলো -শব্দানুকৃতি মানে কি ?"

দত্ত বললো - " সে আবার কি ?"

ভাইটু বললো -" নীলু কি পারলো বলতে ?"

ভ্যামো বললো- " পারলে তো হয়েই যেত -না পারলেও কিছু হতো না - কিন্তু ওই যে ওই আদক - ব্যাটা মানেটাও বলে দিলো আবার ওটার একটা কি ইংরেজি শব্দ বললো খটোমটো ।"

সায়ন এতক্ষন মন দিয়ে শুনছিলো - বললো - " onomatopoeia -sounds similar to the noises they describe - যেমন ধর বৃষ্টি পড়ার শব্দ ।"

দত্ত বললো- " ওরে বাবা ! প্রথমবার শুনলাম ।"

নীলু মাথাটা নাড়তে নাড়তে বললো -" ওখানে পারলাম না বলতে অর্থটা । আদক বলে বেরিয়ে গেলো। কেন -কেন কেন ?"

ভ্যামো বললো- " আদক আর শ্রেয়ার চোখাচোখি হলো -সত্যি বলছি মাইরি !"

আমবাগান বললো- " থাম! তুই আর কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিস না / নীলু শোন্ ভাই এরম হয় । আমরা সোজা শব্দের অর্থ ভুলে যাই আর এতো আবার বৃষ্টির শব্দ ।"

নীলু তবুও মাথা নাড়ছে - " নাঃ ,মানেটা পারা উচিত ছিল।"


সেদিনের আড্ডাটা আর সেরম জমলো না ।

নীলুকে অনেক কষ্টেও বোঝানো গেলো না।

শেষে এলো মুশল ধারায় বৃষ্টি -নীলু , লেবু চা, আর আমার প্রিয় শহর সেদিন ভিজেছিলো অর্থের টানাপোড়েনে ।


এরপর বেশ কিছুদিন নীলুর আর আমাদের আড্ডায় দেখা নেই ।ভ্যামো কে জিজ্ঞেস করলে বলে

-" মনমরা ভাই ।"

*****************************************

একমাস কেটে গেছে - রবিবারের বিকেল । আড্ডার মেনু চপ আর কোকাকোলা । দত্ত খাওয়াচ্ছে - উপলক্ষ্য জন্মদিন ।

ভ্যামো খাওয়ার আওয়াজের মাঝে বললো - "দত্ত তুমি বেঁচে থাকো একশো বছর আর এরম খাওয়াতে থাকো । "

দত্ত বললো - "সবই ঠিক আছে শুধু নীলুটা নেই-থাকলে ভালো হতো।"

আমবাগান দূরে একটা সাইকেল দেখিয়ে বললো - " আরে ওটা তো নিলুই আসছে ।"

ভাইটু বললো- " হ্যাঁ- নিলুই কোনো সন্দেহ নেই।"


নীলুকে বেশ উজ্বল লাগছে - মুখচোখ হাসিখুশি ।

দত্ত বললো - " ভাই তোকেই মিস করছিলাম -আগে চপ তারপর বাকি কথা ।"

নীলু মনাদের দোকানের চপ এ কামড় দিয়ে বললো " দারুন !"


আমরা সবাই তখন উশখুশ করছি ব্যাপারটা কি জানার জন্য ।

ভ্যামো সাহস করে জিজ্ঞেস করলো -" ভাই তোর এই weather চেঞ্জ টা কিরকম ?"

নীলু হাসলো - বললো - " দাড়া আগে খেয়ে নিই।"

আমরা সবাই ওর দিকে তাকিয়ে । নীলু আমাদের সবাইকে একবার দেখে -তারপর কোকাকোলায় এক চুমুক দিয়ে বলতে শুরু করলো -

" তোরা তো জানিস সেদিনের পর খুব মুষড়ে পড়েছিলাম ।

বাড়ি থেকে আর বেরোচ্ছিলামই না । তোদের সাথেও দেখা করছিলাম না ।

মা প্রায় জোর করেই পাঠালো মামাবাড়ি। মামাবাড়ি আমার শ্রীরামপুর। মন সেই একই ।

স্টেশন থেকে বেরিয়ে দেখি মানুষের ভিড়... কিছু একটা হয়েছে ... বোঝবার চেষ্টা করছি কি হয়েছে এদিকে এক ভিখিরী আমায় ছাড়বে না -উস্কখুস্ক চেহারা -গায়ের জামা কাপড় ও ময়লা ,হাতের বাটিতে চার পাঁচটি টাকা - বললো -

কুছ নাহি খায়া সাব,

বললাম দূর হাটো-

মন মেজাজ ভালো নেই তার ওপর এই সব ।

ততক্ষনে ভিড়ের কারণ টা কানে এসেছে - স্টেশনের সামনে এক হাই ড্রেনএ এক গরু পরে গিয়ে পায়ের হাড় ভেঙেছে ।

কিছু বেকার ছেলে জোগাড় হয়েছে -চাঁদা তুলছে - গরু কে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে । আমার কাছেও চাইলো-বললাম নেই ভাই।

বলে রিকসাতে সবে উঠেছি -রিকসা মাহেশের দিকে ঘুরবে।

কি মনে হতে পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একবার । দেখি সেই ভিখারি ওই ছেলেগুলোকে ডাকছে। বাটির টাকা গুলো দিয়ে দিচ্ছে ওদেরকে ।সোজা হয়ে বসলাম রিকসাতে ।


তারপর থেকে অনেক ভেবেছি বুঝলি - সত্যি কি আমরা জীবনের সব অর্থ বুঝতে পারি - না পারি না -বোঝার প্রয়োজন ও নেই । "


দত্ত মৃদু হেসে বললো - " এই তো সেরা কথা ভাই ।"


নীলু চপটা শেষ করে বললো

" তোমরা বসো, আমি একটু নৌকায় নদীবক্ষতে ঘুরে আসি -একটু কাজ আছে ।"

আমরা সবাই থ !

দত্ত বললো - " কী কাজ ? সেটাতো বলা যায় ।"

নীলু তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে ঘাটের দিকে নেমে গেলো উত্তর না দিয়ে , তারপর দূর থেকে চেঁচিয়ে বললো -" হৃদয়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি । শ্রেয়াকে চিঠিটা নৌকা তে বসেই লিখে ফেলবো ।"

ভামো বললো - ব্যাপারটা কি হলো ?

দত্ত বললো -"ও তুমি বুঝবে না ! onomatopoeia...কিসু বুঝলে ?"



সমাপ্ত


Image used for Illustration under Creative Common license...

Short Story "Onomatopoeia" by Nisachar © www.hatekhori.net (2020)

Read on the Go. Download our app now : Click Here

(সব চরিত্র কাল্পনিক )

0 comments
bottom of page