
আমার মধু-মালতি -নিশাচর
Updated: Aug 1, 2020
সেবার মুম্বাই থেকে বাড়ি একাই ফিরছিলাম । স্ত্রী ও কন্যাটি আগেই কলকাতা গেছে । দুরন্তর এসি দু টায়ারের আপার বার্থ , বেশ খানিকক্ষণ আগেই পৌছেছিলাম।
সঙ্গের সুটকেসটা নিচে সিটের তলায় ঢুকিয়ে-উঠে পড়লাম উপরে । একে একে যুবক যুবতী, প্রৌঢ় প্রৌঢ়া আসছে যাচ্ছে ।সংখ্যাতত্ত্বে গভীর মনযোগ সবার-আর মাঝে মাঝে নীল প্রসাধনে রেলের কর্মীরা কখনো হাতে খাতা , নয়, বালিশ -পাশ কাটিয়ে হুড়োহুড়ি ।

সবসময়ই উৎসুকতা থাকে মনে -সামনের সিট এ কেমন মানুষ আসবেন !এলেন-এক ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী ..স্ত্রীটি সন্তানসম্ভবা । আমার লোয়ার টায়ারে এক প্রৌঢ় , গলার আওয়াজে মনে হলো গুজরাটি , আর বাকি দুটো টায়ার তখনো খালি, এদিকে ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে এলো , তাড়াহুড়োয় উঠল এক ভদ্রলোক আর সঙ্গে জীর্ণ এক বৃদ্ধ ।
উঠেই সামনের সিটের স্বামী স্ত্রী কে অনুরোধ করলেন পাশের বগির সাথে সিট বদলের, কারণ ওই বগিতে আছেন ভদ্রলোকের স্ত্রী ও মা । বুঝলাম জীর্ণ বৃদ্ধটি ওনার বাবা ।
সন্তানসম্ভবা স্ত্রীয়ের স্বামীটি বেশ রুহ্র ভাবেই না বললেন । হাতে রইলো দুই , আমাকে আর লোয়ার বার্থের গুজরাটি ভদ্রলোকটিকে অনুরোধ করলেন সিট বদলের , আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ানোয় উনি আশায় চাইলেন গুজরাটি ভদ্রলোকটির দিকে …শুনলাম
" Not Possible " ...
আশা ছেড়ে ভদ্রলোকটি হতাশা নিয়ে বসে পড়লেন সিটে, বাবাকে একধার করে শুইয়ে দিলেন । তারপর আবার উঠে দাঁড়ালেন , আমায় বাংলায় বললেন " ওই কম্পার্টমেন্ট থেকে আসছি , মা আর মিসেস এর সাথে একবার দেখা করে ...একটু বাবাকে দেখবেন। "
মিনিট দশেক পরে ফিরে এলেন ।
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ," বাবার ক্যান্সার ট্রিটমেন্ট করিয়ে ফিরছি , ওই বগিতেও সিট অ্যাডজাস্টমেন্ট হলো না ...কি আর করা যাবে ...মানবিকতা বলে আজ আর কিছু নেই.."
আমি বললাম " কি আর করবেন বলুন !"
" না আসলে বাবা মায়ের উপর খুব ডিপেন্ডেন্ট কিনা , নাম করা উকিল ছিলেন আর আজ কেউ বলবে ? আমি যদিও সামান্য কেরানি । "
জিজ্ঞেস করলাম আবার" উনি কি সুস্থ এখন ?"
উত্তর যেটা এলো তাতে বুঝলাম সুস্থ হওয়ার আশা খুব একটা নেই ।
দুরন্ত শান্তিতে বসতে দেয় না খাবার এর পর খাবার আসতেই থাকে , তাতে অবশ্য সময়টা কাটতেই থাকে ।
চা আর সিঙ্গারা সহযোগে সন্ধের খাবার শেষ করে শরদিন্দুর মধু মালতিতে মন দিয়েছি ...অশরীরী আত্মার মরণোত্তর প্রেম ...গল্পের প্রেক্ষাপট পুনে শহর....দুরন্ত তখন স্বমহিমায় ছুটে চলেছে ...বাইরে বৃষ্টি নেমেছে হয়তো ...
মধু আর মালতী প্রেমিক প্রেমিকা ...অনার কিলিং এর পরেও তাদের আত্মার বিচরণ আর শরদিন্দু মহাশয়ের লেখার জাদু গায়ে শিহরণ জাগায় ।
" আপনার নামটাই জানা হয় নি ?"
হটাৎ করে প্রশ্নটা শুনে তাকালাম ...নাম বললাম ...জিজ্ঞেস করলাম " আপনার ?"
"পরিতোষ সমাদ্দার আর বাবা মধুকর সমাদ্দার ?"
একটা নির্লিপ্ত হাসি দিলাম ...বইতেই আমার মনটা এখন আবদ্ধ বোঝাতে চাইলাম ।
রাতের খাবার ও একসময় এলো ।
উঠে গেলেন উপরের বার্থে ।মধুকর বাবু গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। গুজরাটি ভদ্রলকের কোনো দিকেই ভ্রূক্ষেপ নেই ...আর স্বামী স্ত্রীটি ব্যাস্ত তাদের ভবিষৎ জীবন নিয়ে ।
খাওয়া শেষে সব আলো নিভে এলো।
আমার মাথার উপর রিডিং লাইট টা জ্বালালাম ।
তখন রাত দুটো।বই সরিয়ে রাখলাম।
নেমে এলাম নিচে।
ট্রেন দুলকি চালে চলেছে ...
যেন বলছে - মুসাফির শোতে রাহো।
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম , অনেক রাত-বাইরের ঠান্ডা হাওয়া ঝাপ্টা মারছে মুখে ...।
মধ্যপ্রদেশ এর মধ্যে দিয়ে চলেছি ...মারাঠা বর্গীদের মতন ছুটে চলেছে দুরন্ত...নাঃ এবার শুতে হবে ...ভেতরে ব্যালান্স রেখে নিজের সিটের দিকে চলেছি
কেউ একজন বাথরুম যাবে বলে ওপাশ থেকে আসছে ...দেখি মধুকর সমাদ্দার ...ছেলেকে ডাকেন নি ... ডিম্ লাইট এর মৃদু আলোয় আমার দিকে তাকালেন ...নিষ্পলক চাহুনি ...।

বিছানায় উঠে শুয়ে পড়লাম...
স্বপ্নে দেখলাম মধু মালতি শ্বরদিন্দু আর তাদের ভুতুড়ে সাইকেল ...
কখন সকাল হয়েছে জানি না ...
হুড়োহুড়ি আর লোকের কোলাহলে উঠে বসলাম ধড়ফড় করে ...পুলিশ আর একজন ডাক্তার এসেছেন..
নেমে এলাম ট্রেন থেকে ...ট্রেন অনেকক্ষন দাঁড়াবে । বাজে সকাল ৮.৩০ , ছাড়তে ছাড়তে ৯ টা ।
পরিতোষ বাবু একা বসে আছেন প্লাটফর্ম এর উপর এক সিটে...আমায় দেখে হাতটা ধরলেন
"বাবা চলে গেলেন ..মা এর সাথে শেষ দেখাটাও হলো না ..." বলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন ।
" ডাক্তার বললেন কাল রাতে খাবার পরেই সম্ভবত চলে গেছেন উনি । "
একসময় চলে গেলেন মধুকর বাবু ...
ট্রেন আবার রওনা দিয়েছে ...কলকাতার দিকে ...হতভম্ভ শুধু আমি ...ভেবেই চলেছি ।
মধুকর ...মধু...শ্বরদিন্দু ... মালতি সব গুলিয়ে গেছে ...
আচ্ছা মধুকর বাবুর স্ত্রী মানে পরিতোষ বাবুর মায়ের নাম ও কি মালতি ?
হাওড়া ঢুকছে ট্রেন ।
নামতে হবে ।
কোলাহল কুলি ...দ্রুত গতিতে এগিয়ে চললাম মালপত্র নিয়ে ।