top of page

রহস্যের পুয়াবি – অজানা আজও - উপাসনা চ্যাটার্জী



পশ্চিম এশিয়ার টাইগ্রিস-ইউফ্রেটস নদীর আদরে বেড়ে ওঠা , শুস্ক , তাপমান ও স্বল্পবৃষ্টির মেসোপটেমিয়া নিজের পেটে নানান রহস্য লুকিয়ে রেখেছে, ঠিক যেন মিশরকে অনুসরণ করে সেই রহস্য উদ্ঘাটন যতটা কঠিন, ঠিক ততটাই গভীর।


ভাসাভাসাভাবে দেখলে মেসোপটেমিয়া কেবল একটি দেশ, কিন্তু তার অন্তরালে প্রবেশ করার ইচ্ছে ও শক্তি থাকলে , সে শুধুই একটি দেশ নয়, আদিমযুগ থেকে দেশের ছদ্মবেশে এক অফুরন্ত খাজানার ভান্ডার, যাতে মণিমাণিক্য, ধনসম্পত্তি হয়তো অসীম , কিন্তু প্রাচীন ইতিহাসের অজস্র না জানা অমূল্য টুকরো, যার মূল্য- হিসেবে আটে না, আনাচে কানাচে গুপ্ত আছে তাঁর পাকস্থলীতে ।

মানুষও ভারী নাছোড়বান্দা, যেদিন থেকে চার পা ছেড়ে দুপায়ে দাঁড়িয়ে আগুন জেলে চাকা বানিয়েছে, অনুসন্ধিৎসার নেশা তাদের আজ ও ভবিষৎতের সাথে সাথেকালেও নিয়ে গিয়ে ফেলেছে , যদিও এই কালকে জানা অনেকেরই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তবুও মানুষ হাল ছাড়েনি । আজও জানার তাগিদে কেউ না কেউ খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে , এই গ্লোবের কোনো না কোনো প্রান্তে ।


মেসোপটেমিয়া শুনেই কি আসে আপনাদের মনে ?, ৬০০০ বছর পূর্বের পৃথিবীতে গড়ে ওঠা প্রথম সুমেরীয় সভ্যতা নাকি প্রথম ও প্রাচীনতম লেখার পদ্ধতি কিউনিফর্ম ?


আমরা কমবেশি সকলেই আমাদের ছাত্রজীবনে ইতিহাসের সিলেবাসে এগুলি পড়েছি ,হ্যাঁ কেউ কেউ আমরা মনোযোগ দিয়েছি ,ও কেউ কেউ ক্লাসের সময়ে লাস্ট বেঞ্চে লুকিয়ে ঘুমিয়েছি । তাও পাশ করার তাগিদে, ইচ্ছা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের এগুলি জানতেই হয়েছে, কিন্তু মেসোপটেমিয়া হোক বা সুমেরীয় সংস্কৃতি , আমাদের এই সামান্য জানার তুলনায় অনেক অনেক অনেকটা বেশি প্রসারিত, অজানা ও বিস্তারিত । প্রাচীন মেসোপটেমিয়া বা সুমেরের কয়েকজন রাজার নাম হয়তো আমরা পেয়েছি আমাদের পাঠ্যবইয়ে, কিন্তু সুমেরের ইতিহাসের বাতিঘরে একজন নারীর নামও যে একটি পর্দার আড়ালে ঝলমল করে ঔজ্বল্যমান, তা আমরা অনেকেই জানিনা, যিনি ছিলেন তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য যেকোনো সুমেরীয় রমনীর তুলনায় খানিক ব্যতিক্রমী,অনন্যা ও অদ্বিতীয়া । সেই পর্দাটা "স্বল্প জানার" ,যা ঢেকে দিয়েছে সেই রমণীর "না জানা" ইতিহাস । জুলিয়াস সিজারের ক্লিওপেট্রা বা ট্রোজান যুদ্ধের মূল হেলেনের উল্লেখ আমরা বিশ্বের অন্যতম নারীদের মধ্যে পেয়েছি, কিন্তু এই ব্যতিক্রমী নারীকে আপনাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানেন না, আমিও সদ্য জেনেছি তাঁর ব্যাপারে, তাও আধখেঁচড়া, ধোঁয়া ধোঁয়া ۔۔۔۔۔۔۔

আজ না হয় সেই আধখেঁচড়া,ধোঁয়া ধোঁয়া জানাটাই ভাগ করে নিই আপনাদের সঙ্গে !!....


প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার , ২৬ সেঞ্চুরি বি۔সির এক অত্যন্ত নামকরা ও জরুরি সুমেরীয় শহর ছিল "উর" ও সেই উরের প্রথম ডাইনাস্টির শীর্ষে ছিলেন সেই অদমনীয় নারী ।

১৯২২ ও ১৯৩৪ এর মধ্যে একজন ব্রিটিশ আর্কিওলজিস্ট-স্যার চার্লস লিওনার্ড উলের নেতৃত্বে , উর শহরে খননকার্যের ফলস্বরূপ উঠে আসে এক সমাধি ও তাতে বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য,দেহাবশেষ ও নৃশংসভাবে আঘাত করা এক খুলির টুকরো । নানান দিক ঘেটে খানিক জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হয় সেই কবরে শায়িত ব্যক্তিত্বের সম্বন্ধে । তিনিই সেই অদমনীয় নারী, তাঁর নাম পুয়াবি, যার অর্থ "পিতার বচন"

পিতার কোন বচনরূপে তিনি এসেছিলেন তা জানা সম্ভব হয়নি পুরোপুরি কিন্তু তাঁর ভিন্ন হয়ে ওঠার বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে , দীর্ঘ সময়ের রিসার্চের পর , নানান রকম আর্টিকেল থেকে মানুষ তাকে কিছুটা চিনতে সক্ষম হয় । আমারও তাঁকে চেনা আর্টিকেল ঘেটেই ,দূর থেকেই ।

সুমেরীয় ডায়ালেক্ট অনুযায়ী তাঁর নাম "সুব-আদ" ও আক্কাডিয়ানে "পুয়াবি", প্রথমত খুব বেশি তাঁর পূর্বজীবনের ব্যাপারে খুঁজে পাওয়া সম্ভব না হলেও, ধীরে ধীরে এক্সক্যাভেশনসের নানান দিক নানান দরজা খুলে দেয় ।


বহু যুগ ধরে উরের বুকে শায়িত "তাঁকে" জানা যায় বহু বছর আগের এক শক্তিশালী নারী হিসেবে , হয়তো নিজেই রাজদণ্ড হাতে নিয়ে রাজত্ব করেছেন তিনি বা হয়তো মন্দিরের মহাপূজারিনীর অধিকারে পঞ্চপ্রদীপ ও লক্ষাধিক মানুষের চিন্তন তাঁর হাতেই থাকতো সেইসময় । তাঁর ক্ষেত্রে এই "হয়তো" শব্দটি এখনো তাঁর কাহিনীকে দোদুল্যমান করে রেখেছে ।

প্রাচীনকালে নারীদের শক্তিশালী হয়ে ওঠাটাই একটি দ্বন্দ্ব ছিল, ঠিক তেমনই দ্বন্দ্বের মুখে দাঁড়িয়ে পুয়াবির সামাজিক পদমর্যাদা আজও আবছা হয়ে রয়েছে তাঁর নামের সঙ্গে জড়ানো এই দুটি খেতাবের মধ্যে তা হলো "নিন" ও "এরেশ" , সুমেরীয় ভাষায় যার প্রথমটির অর্থ হলো রাণী ও দ্বিতীয়টির অর্থ পূজারিণী । যদিও বেশিরভাগ মতানুযায়ী তিনি উরের প্রথম ডায়নাস্টির রাজা মেসকালামদাগের দ্বিতীয় মহারানী "নিন পুয়াবি" ছিলেন । উচ্চতায় পাঁচ ফুট পুয়াবির স্বাধীনসত্তার উচ্চতা ছিল আকাশছোয়া , তা বোঝা যায় তাঁর সিলিন্ডার সীল থেকে । তাঁর সমসাময়িক যতজন নারীর সীল উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে, তারা সকলেই তাদের স্বামীদের নামে পরিচিত ছিলেন তা তাদের সীলের ওপর খচিত লিপি থেকে অস্পষ্ট হলেও ধারণা করা যায়, প্রত্যেকের নামের সাথে তাঁদের স্বামীদের নামও খচিত আছে তাঁদের সীলের ওপর,কিন্তু পুয়াবির সীলে তাঁর নাম পাওয়া যায় এককভাবে , তাঁর নামের সাথে তাঁর স্বামীর নামের কোনো উল্লেখই পাওয়া যায়নি তাতে !!!! অবাক করেছিল এই তথ্য সবাইকে, চমকে দিয়েছিলো তাঁর সমাধির এই দুর্লভ অনন্যতা !!


তখন থেকে ধরে নেওয়া হয় যে তিঁনি তাঁর নিজের রাজত্বের অধিকারিণী ছিলেন, নিজস্ব বলে, নিজস্ব জোরে । তাঁর স্বামীর নামও সুমেরীয় রাজাদের নামের তালিকায় তালিকাভুক্ত ছিলোনা, তাঁর চিহ্নও স্যার উলেই খুঁড়ে বের করেছিলেন ১৯২৪ শে "দি রয়াল সিমেট্রি" থেকে,ঠিক যেখান থেকে তিনি পুয়াবির সন্ধান পেয়েছিলেন । পুয়াবির মৃত্যুর সঠিক হেতু জানা না গেলেও জানা যায় যে মৃত্যুকালীন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ ও তাঁর মৃত্যু সাধারন মৃত্যু একেবারেই ছিলোনা ।

পুয়াবির দেহাবশেষ প্রায় ছাই হয়ে গেলেও , ইউনিভার্সিটি অফ পেনিসেলভেনিয়া মিউজিয়ামের CAT স্ক্যানে উঠে আসে তাঁর মৃত্যুর চাঞ্চল্যকর তথ্য, জানা যায় খুবই মর্মান্তিক সমাপ্তি হয়েছিল পুয়াবির । অত্যন্ত হিংস্রতার সাথে,হয়তো কোনো ধারালো ও ছুঁচলো অস্ত্র দিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করা হয়েছিল, ও তাতেই তিঁনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ।


উলে পুয়াবির সমাধির সাথে উদ্ধার করেছিলেন বেশ কয়েকটা "ডেথ পিট্" । প্রাচীন সুমেরীয় রীতি অনুসারে প্রত্যেকটি মৃতদেহের জন্যে থাকতো চেম্বার, যার মধ্যে দেওয়া হতো সোনা দানা, খাবার এমনকি ভৃত্য ও দাসীও , কখনো সেই মৃত মানুষের সাথে সেই ভৃত্য ও দাসীদের জোর করেই জীবিত অবস্থায় সমাধিস্থ করা হতো অথবা কখনো হত্যা করে । পুয়াবির চেম্বারের আসে পাশে বেশ কয়েকটি এমন ডেথ পিট্ খুঁড়ে বের করেছিলেন উলে !! ۔۔۔۔ পুয়াবীর চেম্বারের ওপরেও ডেথ পিটের সন্ধান পেয়েছিলেন তিনি যেখান থেকে তিনি একটি লিরি বাদ্যযন্ত্র ও একুশজন পরিচারক পরিচারিকার দেহাবশেষ উদ্ধার করেছিলেন ।পুয়াবিকেও সমাধিস্থ করা হয়েছিল বাহান্ন জন ল্যাপিজ ল্যাজুলি ও রুপো দিয়ে মোরা দাস দাসী উপহার দিয়ে , তাদের মধ্যে অবশ্য তিনজন ছিল কম সজ্জিত ও তাঁদের রানীর দেহের একদম কাছে l হয়তো তারা ছিল তাঁর খাস !!, সেটা যদিও স্পষ্ট নয় ।

পুয়াবির হাতে আঁকড়ানো ছিলো একটি সোনার কাপ ও দামি হীরে জহুরতে সাজানো তাঁর মাথা ছিল পশ্চিমে শায়িত । উলের খননকার্যের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য "খুঁজে পাওয়া" হলো , পুয়াবির মাথার মুকুটটি, যেটি পুয়াবির "হেডরেস" নামে বিখ্যাত ।


পুয়াবিকে নিয়ে নানান রিসার্চ চলাকালীন এক কন্ট্রোভার্সিয়াল মন্তব্য করে বসেন একজন রিসার্চার ও লেখক Dr যেছাড়িয়া সিটচিন, যিনি পুয়াবিকে "নিবিরু" নামের এক ভিন গ্রহ থেকে আগত আনুননাকি প্রজাতির "এলিয়ান" বলে ব্যাখ্যা করেন।

তাঁর ব্যাখ্যায় ভিরমি খান ইতিহাসবিদরা ও তিনি নিজে হাসির খোরাক হন বিজ্ঞানীদের কাছে ।তাঁর মতানুযায়ী পুয়াবির পিতা ছিলেন একজন ডেমিগড মানে উপদেবতা, নাম লুগালবান্দা ও ভাই গিলগামেশ, দুই সন্তানের জননী পুয়াবি তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর একাকিত্বের সঙ্গে রাজ্যপাট হাতে তুলে নেন ও নিবিরুর বদলে এই পৃথিবীতেই মৃত্যপূর্বে শায়িত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন । সিটচিনের কথায় তাঁর আভূষণ ও মুকুট সে তাঁর দুই ঠাকুমা ইনান্না ও গুলার কাছ থেকে পান । “পাগল”,”সিউডো সাইন্টিফিক”, “ইল্লজিকাল” এই ধরণের নানান ব্যাঙ্গাত্মক উপাধি নিয়ে ও তাঁর কথা একদিন সত্যি প্রমানীত হবে এই আশায় বেশ কয়েক বছর আগে পৃথিবী ছেড়েছেন সিটচিন ।

সিটচিন ভুল ছিলেন না ঠিক, আজও তার কোনো ঠোস সাবুত মেলেনি , শুধু বোঝা গেছে যে এই রহস্যময়ীর রহস্যভেদ এত সহজ নয় ও তাঁর আলোআঁধারী গাঁথা আজও এক রহস্য ।

পুয়াবিকে হয়তো খুন হতে হয়েছিল তাঁর শক্তিশালী পদের জন্যে বা হয়তো কোনো দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিলেন তিনি, আসল সত্যি স্বচ্ছভাবে কেউ জানে না , এমনকি উলেও না ।

ধোঁয়াশার মধ্যে , টুকরো টুকরো তথ্যের কোলাজ, কিছু "এসাম্পশনস" ,কিছু ঠিক বেঠিক দিয়ে , শুধু এইটুকু আঁকা যেতেই পারে যে হয়তো নারী স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিলেন পুয়াবি , সেই সময়ের উরের ভূমিতে।

এই রহস্যের আড়ালের আরো একটি রহস্য দিয়ে এই লেখায় ইতি টানবো, জানা গিয়েছে আজ পর্যন্ত "দি রয়েল সিমেট্রি" র চেম্বার গুলিতে অজস্রবার লুট হয়েছে, সোনাদানা, রত্ন মানিক্য নিয়ে চম্পট দিয়েছে লুটেরারা, কিন্তু এই একটি সমাধি,এই একটি চেম্বার যেখানে শায়িত ছিলেন “সেমেটিক আক্কাডিয়ান” পুয়াবি,তা রয়ে গেছে অক্ষত , একটা নূরীও কেউ সেখান থেকে সরায় নি বা হয়তো সরাতে পারেনি বা হয়তো কেউ সরাতে দেয়নি !!!!!

কে রক্ষা করেছে সেই চেম্বার ???? ~~~~ তা জানা যায় নি , যদি বলি যা তাঁর নিজের -পুয়াবি তা নিজেই হয়তো রক্ষা করেছেন, তাঁর রক্ষক দাসদাসীদের মদতে , তখন আপনাদের হয়তো আমাকেও সিটচিনের মতনই উম্মাদ আখ্যা দেওয়ার ইচ্ছে হবে ।

তাই কাটাছেড়ায় আজ না যাওয়াই শ্রেয় ।

অপেক্ষা করা যাক এই রহস্য মোচনের -ততদিনে আপনি ,আমি আমাদের জানার স্পৃহাকে সজ্জীব রাখি, অনুসন্ধিৎসাকে বেড়ে উঠতে দিই , পুয়াবি শান্তিতে স্বপ্ন দেখুক ও ঝলমল করুক তাঁর মাথার মুকুটটা, ঠিক তার খুঁজে পাওয়া "হারানো অস্তিত্বের" মতন ।


(Pictures in Video Courtesy of Wikipedia and other Google Images)

bottom of page